আমার নামের আগে “সৈয়দ” বলে দিচ্ছে আমি “বড়” বংশের। আমার পূর্ব পুরুষ ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন। সুতরাং আমি ‘আশরাফ মুসলিম’। আমার গায়ের ‘রঙ’ দ্যেখো টকটকে গৌর বর্ণের। তোমাদের দেশের কালিমা বা ছোটলোকি আমার মাঝে নেই।আমরা নবাবি আমল থেকে ‘ধনী’।
আমার পুর্বপুরুষের ভিটা ইটের দালান; ‘মেঝের মার্বেল’ এসেছিলো ‘ইটালি’ থেকে ‘জাহাজে’ করে, সেই জাহাজ এসে থেমেছিলো ‘কলকাতা’ বন্দরে।
বৃটিশদের সাথে আমার প্রপিতামহের ব্যাবসা ছিলো।আমার শ্বশুরবাড়ির ওরা খানদানি ফ্যামিলি। ঢাকার নবাবদের সাথে ওদের ওঠাবসা ছিলো। ওদের প্রতিটি ঘরে ‘পারস্যের গালিচা’ বিছানো; গালিচা বিছানোর কারিগর এসেছিলো ‘হায়দ্রাবাদ’ থেকে। আমার বিয়ের সময় যে দস্তরখান বিছানো হয় তাতে বসে ‘শাহ সুজা’ পর্যন্ত আহার গ্রহণ করেছিলেন।
আমার দাদা পোলাও খেয়ে পুকুরের যেই ঘাটে হাত ধুতেন সেই ঘাটের পানি নিয়ে যেতো গায়ের লোকেরা, সেই পানি দিয়ে রান্না করবে বলে (ঘী মিশে থাকতো সেই জলে)।আমাদের ঘরের কুকুরগুলি লেডি কার্জনের উপহার দেয়া সেই টম কুকুরের বংশধর। যেই পায়রাগুলো উড়ছে ছাদে, বাড়ির আশে পাশে সেগুলোর পুর্বপুরুষদের আনা হয়েছে বাহাদুর শাহের লাল কিল্লা থেকে।ঐ ডাব গাছের পানি দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়েছে ফজলুল হক সাহেবকে, সোহরাওয়ার্দি সাহেবকে, মাওলানা সাহেবকে; শেখ সাহেবও ছিলেন সাথে, ছিলেন মোশতাক সাহেবও। জেনারেল জিয়া আমার বাবার বসানো নলকূপের পানি খেয়ে বলেছেন, বাহ্ বেশ মিষ্টি ; হাতের আজলা ভরে তিনি পানি পান করেন, চোখে ছিলো তার রেব্যান সানগ্লাস। বন্যা হলে গামবুট পড়ে জেনারেল এরশাদ আমার কাচারি ঘরে এসে বসেন; তাকেও ডাবের পানি দেয়া হয় খেতে। হালকা চুমুক দ্যেন তিনি। রুমাল দিয়ে ঠোট মোছেন। আসলেই ব্যাবহারে বংশের পরিচয়। তাকে জাম্বুরা মাখিয়ে দেয়া হলে তিনি বল্লেন জাম্বুরা তার খুব প্রিয় ফল। সরিষার তেল, কাচা লঙ্কা দিয়ে মাখানো আর হালকা ধনে পাতা ছিটানো জাম্বুরা খেতে খেতে তিনি যেনো তার শৈশবে ফিরে গেলেন। আহ্ সেই নিষ্পাপ মুখচ্ছবি! আহা এই সরলতাই তার পতন ডেকে এনেছিলো। ছোটজাতে ভরা এই দেশের যোগ্যতা নেই গণতন্ত্র চর্চা করা বা বুঝার। এদের জন্য সহীহ ছিলো লৌহমানব আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি। আমার ভোটের মূল্য আর ঐ জোলা, কামার, কুমার, বাইদ্যা, দিনমজুরের ভোটের মূল্য এক! আমার কথা আর ঐ অন্ধ মিসকিন, আমার ঘরের দাসী, কামলার কথার ধার একই! আমার জ্ঞান আর ঐ মাঝি, জাউলা, সহিসের বুঝার ক্ষমতা এক! ঐ ঘ্যাগওয়ালা ভিখারি, মুচি আর আমার ভোটের কোনই তফাত নাই! “যেইদিন থিকা মুড়ি আর মুড়কির একই ‘দর’ হইলো সেইদিন থিকা এই দ্যাশের সর্বনাশ হইলো”।
No comments:
Post a Comment